চট্টগ্রাম, ২৭ নভেম্বর : চট্টগ্রামে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) সাইফুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ছয়জনকে ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়েছে। বুধবার (২৭ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ফেসবুকে দেওয়া ওই পোস্টে বলা হয়, হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন অন্তত ছয়জনকে আটক করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে এই ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার সংঘর্ষ চলাকালে ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে ২১ জনকে আটক করেছে সিএমপি। বন্দরনগরে ককটেলসহ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সিএমপি জানিয়েছে, চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা ও আইনজীবী হত্যার অভিযোগে ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে নগরীর কোতোয়ালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে যৌথ বাহিনী। খুনের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা যাচাই-বাছাই করছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা ও আইনজীবী খুনে মামলার প্রস্তুতিও চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আইনজীবী হত্যার নিন্দায় ড. ইউনূস
এর আগে মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে ধৈর্য ধারণ এবং কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রামের সব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসহ বন্দরনগরীতে নিরাপত্তা জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন।
চিন্ময়কে দুষলেন নাহিদ
এদিকে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে যে সকল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে তাদের অবশ্যই কঠোর শাস্তি হবে।
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া আন্তরিকভাবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বিভিন্ন সভা সমাবেশে মিথ্যা ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হওয়া সত্ত্বেও কোনো আইনগত পদক্ষেপ না নিয়ে বিভিন্ন সভা করে বেড়াচ্ছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ। মূলত এই ধরনের তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং বাংলাদেশ ও জুলাই অভ্যুত্থানকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা। ভারতীয় মিডিয়া এরকম মিথ্যা প্রচারণা বরাবরই করে আসছে।’
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আজকে চট্রগ্রাম আদালতে যেভাবে একজন আইনজীবীকে চিন্ময় কৃষ্ণের সমর্থকরা কুপিয়ে হত্যা করলো তা নজিরবিহীন। দেশে সম্প্রীতি বিনষ্ট করার পরিকল্পনা নিয়েই চিন্ময় কৃষ্ণ কাজ করছিল এবং সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে এ ধরনের সন্ত্রাসী সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করেছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ বরাবরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে একটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে চেযেছে। এখন ভারতীয় মিডিয়াও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি করতে চাচ্ছে। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করবো। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নাশকতাকারী হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের আইনি প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ বিচার নিশ্চিত করবে। সবাইকে ধৈর্য ধারণ ও শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। দ্রুতই সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা হবে।’
ঠান্ডা মাথায় আইনজীবী খুন
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে বেরিয়ে সড়কের উল্টোপাশে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। ওই সময় ধারালো অস্ত্রধারী অজ্ঞাতপরিচয় একদল যুবক তাকে টেনেহিঁচড়ে পার্শ্ববর্তী রঙ্গম কমিউনিটি সেন্টারের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এডভোকেট সাইফুল হাত, মাথা ও পায়ে গুরুতর আঘাত পান। মুমূর্ষূ অবস্থায় সাইফুলকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সকালে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মুক্তির দাবিতে আন্দোলনকারীরা চট্টগ্রাম আদালত ভবনে জড়ো হয়েছিল।
নিহত আইনজীবী সাইফুল তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইফুল ২০১৮ সালে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হওয়ার পর তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবেও নিবন্ধিত হন। সাইফুলের বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকায়। এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় যাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে শ্রীবাস দাশ, শারকু দাশ, ছোটন, সুজিত ঘোষ, উৎপল ও এনামুল হক নামে ছয়জনের নাম জানা গেছে। সংঘর্ষ চলাকালে চট্টগ্রামের চারজন ফটো সাংবাদিকের মোটরসাইকেল ভাংচুর করে দুর্বৃত্তরা। এরা হলেন— দেশ রূপান্তরের আকমাল হোসেন, বিডিনিউজের সুমন বাবু, আমাদের সময়ের আবু সাঈদ মোহাম্মদ তামান্না ও সারাবাংলার শ্যামলনন্দী।
এর আগে সোমবার (২৫ নভেম্বর) রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পর মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বেলা ১১টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে মহানগর হাকিম ষষ্ঠ কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে তোলা হয়।
শুনানি শেষে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে চিন্ময় কৃষ্ণকে প্রিজনভ্যানে ওঠানো হয়। তবে তার অনুসারীরা এ সময় বাধা দিলে প্রিজনভ্যানটি প্রায় তিন ঘন্টা সেখানে আটকে থাকে। পরে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিতে চাইলে বিকেল তিনটার দিকে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। আন্দোলনকারী এ সময় আদালত এলাকার একটি মসজিদসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা ভাঙচুর করে। পুলিশও এ সময় কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। লাঠিচার্জও করে। পরে চিন্ময় কৃষ্ণকে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পেছনে দেশের ভেতরে-বাইরে থেকে ইন্ধন থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এ–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিভিন্ন জায়গায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পেছনে দেশের বাইরের এবং দেশের ভেতরের দু-একটি পার্টি আছে, তাদের ইন্ধন থাকত পারে। এ ছাড়া যাদের ব্যান (নিষিদ্ধ) করা হয়েছে, তাদের থেকেও হয়তো কিছুটা ইন্ধন আছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan